1. iukowsar22@gmal.com : Abakash_Admin :
পাহাড়ে বিভাজন আছে, মিলন নেই - দৈনিক অবকাশ
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ০৫:২৬ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ সংবাদ:
ঢাকায় বিজয় দিবস উপলক্ষে দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ ইবির শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে জামাত পন্থীদের জয় নিশ্চিত করতে ভিসির নিজস্ব প্যানেল দাঁড়! গাজায় যুদ্ধ বন্ধ না করলে বাইডেনকে ভোট দেবেন না মার্কিন মুসলিমরা শেখ হাসিনা ও মোদি যৌথভাবে উদ্বোধন করলেন আখাউড়া-আগরতলা আন্তসীমান্ত রেল সংযোগ বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ, যে বার্তা দিল আবহাওয়া অফিস ‘টাকা পে’ কার্ড উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী অবরোধের দ্বিতীয় দিনে রাজধানীতে বেড়েছে যান চলাচল বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না ইবি প্রক্টর আজাদের সুন্দরগঞ্জে হরতাল-অবরোধ বিরোধী সভা ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে ৭ আসামিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিলেন হাইকোর্ট

পাহাড়ে বিভাজন আছে, মিলন নেই

প্রতিবেদকের নাম:
  • প্রকাশিত সময় : রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

পাহাড়ে বিভাজন নতুন কিছু নয়। সবকিছুতে কয়েকটি করে গ্রুপ পাওয়া যাবে। রাজনীতিতে যেমন বিভাজন আছে, ছাত্রদের মধ্যেও আছে। সংস্কৃৃতিকর্মীরাও বিভক্ত। আরও একটু তলিয়ে দেখলে প্রতিটি বিভাজনের শাখা-প্রশাখাও পাওয়া যাবে। আগে ছিল পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ। সেই পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ভেঙে কয়েকটি গ্রুপ হয়েছে। পাশাপাশি জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক ছাত্র সংগঠনও আছে। এ সংগঠনের মধ্যেও আছে বিভাজন।

পাহাড়ে আছে মারমাপাড়া, চাকমাপাড়া, খিয়াংপাড়া, বমপাড়া, ম্রোপাড়া। তাঁদের ধর্ম নিয়েও আছে বিভাজন ও গ্রুপিং। পাহাড়ে যে ক’টি পাড়াতে মিলেমিশে সবাই বসবাস করছিল, সেগুলো পয়সাওয়ালা, চাকরিওয়ালারা জায়গাজমি কিনে ভাগ করে ফেলেছে। যেমন পানখাইয়াপাড়া আর পানখাইয়াপাড়া নেই। ভাগ হতে হতে এখন লোকে চেনে মধুপুর, আনন্দনগর, মিলনপুর, সুইচ গেট ইত্যাদি নামে। মহালছড়িতে চিনিঅং মহাজনপাড়াকে চাকরিজীবিরা রাতারাতি পাল্টে দিয়ে করেছেন বাবুপাড়া। এমন অনেক উদাহরণ আছে। সেই সুযোগে কিছু আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘ক্যাপাসিটি বিল্ডিং’, ‘কমিউনিটি এমপাওয়ারমেন্ট’-এর কথা বলে বড়, পুরোনো পাড়াগুলোকে উত্তরপাড়া, দক্ষিণপাড়া, মধ্যমপাড়া, আগাপাড়া ইত্যাদি নামে ভাগ করে দিয়েছে।

আমরা সবাই ভাগ করতে আর নিজেদের উপস্থিতিকে আরও একটু ভালোভাবে তুলে ধরতে পছন্দ করি। মিলেমিশে থাকার সৌন্দর্যকে উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে দেখতে পারিনি। এ ছাড়া চাকরিজীবীদের মধ্যে ব্যাংকার, বিসিএস কর্মকর্তা, পণ্ডিত, স্থানীয় এনজিও কর্মী, আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মী শুধু নয়; নানা বাগান মালিক সমিতিও রয়েছে। এখন আলাদাভাবে কাঁঠাল, কলা, পেঁপে বাগান মালিক সমিতি গঠিত হওয়াটাই বাকি।

সমিতি থাকা, সংগঠন করা দোষের কিছু নয়। সংগঠন থাকলে নিজেদের সমস্যা তুলে ধরা যায়। নীতিনির্ধারকদের কাছে বিষয়গুলো পৌঁছানো যায় এবং তা গুরুত্ব পায়। সবাই নানা উদ্দেশ্য নিয়ে ফোরাম করে। এই ফোরামগুলো প্রতি বছর ডিসেম্বর এলে আরও দৃশ্যমান হয়। নিজেরা পিকনিক, নাচ-গান আর খাওয়াদাওয়ার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে জানান দেয়।

সবার দেখাদেখি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক পাহাড়ি শিক্ষার্থীরাও ফোরাম, সমিতি করে পিকনিক করছেন। ফলে দেশে যতগুলো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হবে, আগামীতে পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের নিয়ে ততগুলো ফোরাম হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দেখে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বসে থাকবেন কী করে! একদিন তাঁরাও বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক কমিটি দাঁড় করাবেন।

পাহাড়ে আমরা অল্প ক’জন মানুষ। সবাই সবাইকে চিনি-জানি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে আমরা প্রত্যেকে বন্ধুবান্ধব, ভাইবোন। ফলে এমন দিন আসছে যখন ডিসেম্বর এলে পুরো মাসটি কাটবে পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের বেড়ানো, পিকনিক, খাওয়াদাওয়ার ছবি দেখে এবং তাঁদের ছবিগুলোতে লাইক দিয়ে। আমার সহপাঠী বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। যাওয়ার সব প্রস্তুতি নিয়েও শারীরিক অসুস্থতার কারণে যেতে পারিনি। পরে তাদের দেওয়া ফেসবুক পোস্টগুলো দেখে মনে হয়েছে, না যেতে পেরে একদিকে ভালোই হয়েছে। সহপাঠীরা ২০-২২ বছর পরে ক্যাম্পাসে গিয়ে কিছু দেওয়ার, শেখার বদলে ক্যাম্পাসকে দূষিত করেছে। তারা সেখানে ব্যান্ড পার্টি নিয়ে র‌্যালি আর কিছু সস্তা জনপ্রিয় গান বাজিয়ে নেচেছে মাত্র। গত দুই দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার কী পরিবর্তন হলো, আদৌ কোনো পরিবর্তন হলো কিনা- কিছুই জানার চেষ্টা করেনি। শিক্ষকদের নিয়ে কোনো গঠনমূলক আলোচনা দেখিনি।

একইভাবে আমাদের পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক পুনর্মিলনী আয়োজন করেছেন। সেখানেও যাব বলে আগে থেকে সব আয়োজন করে রেখেছিলাম। শেষ বেলায় এসে বারবার তারিখ পরিবর্তন হতে থাকলে অংশ নিতে পারিনি। জেলা শহরে গিয়ে দু’সপ্তাহ অপেক্ষা শেষে খালি হাতে ফিরেছি। পরে ফেসবুকে দেওয়া পোস্টগুলো দেখে মনে হলো, সেখানেও অংশ নেওয়ার সুযোগ না পেয়ে ভালোই হয়েছে। তাঁরা সেখানে লাকি কুপন, হাউজি খেলা, গানবাজনা করেছেন মাত্র।

সবাই শৈশবে ফিরে যেতে চাই। কয়েক বছর পরে কিংবা সারা বছরে একবার, তাও কয়েক ঘণ্টার জন্য একত্র হওয়ার সুযোগ পাই। সেই সুযোগ হাউজি খেলে নষ্ট করতে দেখলে আমার রাগই হতো। নিজেদের সুখ-দুঃখ, শিক্ষাসংশ্নিষ্ট স্বপ্ন, নিজ নিজ জাতিগোষ্ঠীর সমস্যার পাশাপাশি কোটা সমস্যা নিয়ে কথা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় বেড়েছে, কোটা বাড়েনি। কোটাগুলোয় শহরের শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা ভাগ বসাচ্ছেন। মেডিকেল আর ডেন্টালে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাহাড়ি সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে, পাহাড়ি সেজে কোটাগুলো ভোগ করা নিয়ে কারও কোনো বক্তব্য দেখা যায় না। আরও মজার ব্যাপার হলো, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো পাহাড়ি বড় পদে থাকলে তাঁকে নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনে ‘শব্দ’, ‘বাক্য’ নিয়েও হিসাবনিকাশ চলে। স্মৃতিস্মারক প্রকাশ করতে গিয়ে প্রকাশনা ‘ভারী’ করার নামে একটি বাণীর জন্য নিজেদের ‘ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর’ করতেও সমস্যা মনে করেন না।

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক নানা ফোরাম করি সত্য, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনিয়ম হতে দেখলেও টুঁ শব্দটিও করি না। উপাচার্যকে নিয়ে কত কথা, কত আলোচনা চলে, প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সে বিষয়ে সোচ্চার হতে দেখা যায় না। উপাচার্য বছরব্যাপী ক্যাম্পাসে না থাকলেও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের ওই উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিতে দেখা যায় না। নিয়োগ নিয়ে উপাচার্যরা কত কত সংবাদ শিরোনাম হয়ে আসেন, সে সময়েও আমরা কোনো কথা বলি না।

আমরা যদি নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ওয়াচডগ’ হতে না পারি, গঠনমূলক সমালোচক হতে না পারি- এসব কমিটি, ফোরাম করে কী লাভ? দল বেঁধে উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে যদি ‘স্যার এমন কাজ করবেন না, যাতে আমাদের লজ্জা পেতে হয়’ বলে আসতে না পারি, তাহলে আমাদের কী লাভ আর বিশ্ববিদ্যালয়েরই বা কী লাভ? কার স্বার্থে আমরা ফোরাম করছি? পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক কত কত ফোরাম, কত শত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী- সবাই হিলের হলেও কোনো সমস্যায় কাউকে আওয়াজ দিতে দেখা যায় না। লামায় খাবার পানিতে বিষ প্রয়োগ হতে দেখেও কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোরাম নিন্দা জানায়নি। গত কয়েক মাসে পাড়াটিকে কতবার পুড়িয়ে দেওয়া হলো, একটা বিবৃতিও পাওয়া যায়নি। এমন মরা, ঘুমন্ত ফোরাম থেকে কী লাভ?

পাহাড়ি যাঁরা বিদেশে অবস্থান করছেন, তাঁরাও ফোরাম করছেন। বিদেশে থেকে বছরে কোনো কাজে ৫০-১০০ ডলার দিতে পারলে খুশি হওয়ার প্রবাসী সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রবাসীদের মাঝে আমরা বিশেষ করে শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী মংসানু মারমার মতো মানুষ চাই। যিনি শত ব্যস্ত থেকেও সবার খোঁজখবর রাখেন, সব ইস্যুতে কথা বলছেন। মানিকছড়িতে একটি স্কুলও চালাচ্ছেন। একইভাবে প্রিয় সুগত তালুকদার দার মতো মানুষ চাই, যিনি নিজের পকেট থেকে বৃদ্ধদের সেবা দিয়ে চলেছেন। পাশাপাশি কিছু ছাত্রকে বৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। অন্যদিকে অনেক প্রবাসী আছেন, তাঁরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য টাকা পাঠান, খরচ করেন। আমরা বলব, এখানে সবাই ধর্মের জন্য পাগল। ধর্মের জন্য পাহাড়ে পয়সার অভাব নেই, অভাব আছে মিলেমিশে থাকার মূল্যবোধ চর্চার। ভালো কাজে হাত বাড়ানোর।

পাহাড়ে কবি ফোরাম, লেখক ফোরামও আছে। ছবি তোলার গ্রুপও আছে। ছবি তুলতে গিয়ে সুন্দরী নারীরা কোন বিহারে গিয়ে প্রার্থনায় বসলেন, সেই খবর দিতেই বেশি সময় ব্যয় করতে দেখা যায়। তাদের কাজগুলো দেখলে মনে হবে, বিহারে শুধু সুন্দরীরাই যান। আমাদের চেনাজানা কবিদের কবিতাগুলোতে প্রেম, ভালোবাসা, সুখ-শান্তির বার্তাই পাওয়া যাবে। তাঁদের কবিতায় দুর্গম পাহাড়ে খাদ্য সংকটের কথা, ইঁদুর আক্রমণের কথা, জুম ভূমির গল্প, পাথর তুলে পানির উৎস ধ্বংসের গল্প, পর্যটকদের ভয়ে নারীদের পানি সংগ্রহের সময় পরিবর্তনের গল্প, পানির জন্য নারীদের সংগ্রামের গল্প নেই। তাই প্রশ্ন করি, পাহাড়কে পাহাড়ের মতো করে দেখার, বলার, ছবি তোলার ফোরাম আছে কি?

আমরা শত শত ফোরাম চাই না। কয়েকটি ফোরাম থাকুক, যেগুলোতে পাহাড়ের প্রকৃত ছবি পাওয়া যাবে। ফোরাম পাহাড়ের কথা বলবে। সুন্দর পাহাড় নিয়ে কথা বলবে। একই সঙ্গে পাহাড় অসুন্দর হয়ে উঠলে অখুশি হবে। নিজেদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো-মন্দের খোঁজখবর রাখবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অসুন্দর কিছু দেখলে লজ্জিত বোধ থেকে উপাচার্য বরাবর চিঠি লিখবে, বিবৃতি দেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে চিন্তার ক্ষেত্র হবে বৃহৎ, বিশাল। নিজেদের সমস্যার পাশাপাশি সবকিছু নিয়ে কথা বলবে। শুধু পাহাড়ি ছাত্র বলে নিজেদের পাহাড়ে আটকে রাখবেন না, তাঁরা হবেন সারাদেশের। সম্ভব হলে পৃথিবীর নাগরিক হবেন। আমরা যদি চিন্তার পরিসর বড় করতে পারি, অনেক বন্ধু পাব। আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান আপনিতেই হবে। অনেকে এগিয়ে আসবেন। পাহাড়ি কৃষিবিদ গ্রুপও আছে। এই কৃষিবিদরা জুম চাষ নিয়ে কথা বলেন কিনা জানা নেই। তবে নিয়মিত পিকনিক করেন। তাঁরা জুম নিয়ে মানুষের নেতিবাচক ধারণা ভাঙতে সাহায্য করেন না। স্বল্প জ্ঞান নিয়ে জুমকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার প্রবণতার ফলে জ্ঞানের দ্বন্দ্ব থেকেই যাচ্ছে। তাই বলব আমাদের মৌসুমি গ্রুপ বা ফোরামের দরকার নেই। দরকার গঠনমূলক কাজের সহযোগী। যাঁরা পাহাড়কে প্রতিনিধিত্ব করবেন। বৈচিত্র্য ধারণে সমাজ ও দেশকে সহায়তা করবেন।

অনুগ্রহ করে এই পোস্টটি শেয়ার করুন

More News Of This Category
© All rights reserved © 2023 Effective News
Developed BY: Next Tech